ওমিক্স (Omics) হল আধুনিক জীববিজ্ঞানের এমন একটি ক্ষেত্র, যা জীবের বিভিন্ন জেনেটিক এবং কোষীয় তথ্যকে বিশ্লেষণ করে। এই ডেটা জীববিজ্ঞানে এক বিপ্লব ঘটিয়েছে, কারণ এর মাধ্যমে আমরা জীবের সামগ্রিক জেনেটিক তথ্য এবং বিভিন্ন কোষীয় কার্যকলাপ সম্পর্কে বিশদভাবে জানতে পারি। ওমিক্স ডেটা বলতে এমন ধরনের তথ্য বোঝানো হয়, যা জীবের বিভিন্ন স্তরের তথ্য বিশ্লেষণ করে, যেমন ডিএনএ, প্রোটিন, মেটাবলাইট, ইত্যাদি।
ওমিক্স ডেটা হল জীবের বিভিন্ন জৈবিক স্তরের বড় ধরনের তথ্যের সমষ্টি। এই ডেটা কয়েকটি প্রধান ভাগে বিভক্ত, যেমন:
1. জেনোমিক্স (Genomics): ডিএনএ বা জেনেটিক তথ্য সম্পর্কিত ডেটা।
2. প্রোটিওমিক্স (Proteomics): প্রোটিনের কার্যকলাপ এবং গঠন সম্পর্কিত ডেটা।
3. মেটাবোলোমিক্স (Metabolomics): কোষে বিভিন্ন মেটাবলাইট বা জৈব রাসায়নিকের স্তর সম্পর্কিত ডেটা।
4. ট্রান্সক্রিপটোমিক্স (Transcriptomics): ডিএনএ থেকে আরএনএ তৈরি হওয়ার প্রক্রিয়া সম্পর্কিত ডেটা।
ওমিক্স ডেটার ইতিহাস তেমন পুরনো নয়। ১৯৯০-এর দশকে মানুষের জিনোম প্রজেক্টের মাধ্যমে প্রথমবারের মতো জীবের জেনেটিক কোড বিশ্লেষণ শুরু হয়। এই প্রজেক্টের সাফল্যের পর বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারেন, জীবের শুধু ডিএনএ-ই নয়, বরং কোষে আরও অনেক স্তরে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য থাকে। এরপর ওমিক্স গবেষণা শুরু হয় এবং বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন স্তরের তথ্য বিশ্লেষণ করতে শুরু করেন, যা জেনেটিক্স, প্রোটিন স্টাডি, মেটাবলিজম এবং অন্যান্য কোষীয় কার্যকলাপের ওপর নির্ভর করে।
ওমিক্স ডেটার সবচেয়ে বড় গুরুত্ব হলো এর মাধ্যমে আমরা জীবের জৈবিক প্রক্রিয়া সম্পূর্ণভাবে বুঝতে পারি। এটি বিভিন্ন রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উদাহরণস্বরূপ, ক্যান্সার বা হৃদরোগের মতো জটিল রোগগুলো কীভাবে শরীরে ছড়ায়, কোন জেনেটিক বা প্রোটিন লেভেলের পরিবর্তন রোগের কারণ হতে পারে, তা ওমিক্স ডেটা বিশ্লেষণের মাধ্যমে জানা সম্ভব।
বর্তমান যুগে, ওমিক্স ডেটার গুরুত্ব অপরিসীম। মেডিক্যাল গবেষণায় এটি নতুন নতুন রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসার পথ খুলে দিচ্ছে। জিনোমিক্সের মাধ্যমে রোগের জেনেটিক কারণগুলো বোঝা যাচ্ছে, প্রোটিওমিক্সের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রোটিনের কার্যকলাপ বিশ্লেষণ করা হচ্ছে এবং মেটাবোলোমিক্সের মাধ্যমে মেটাবলিজমের উপর এর প্রভাব দেখা যাচ্ছে। এই তথ্যগুলোর সমন্বয়ে ব্যক্তিগতকৃত চিকিৎসার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, যেখানে একজন ব্যক্তির জেনেটিক বা প্রোটিন ডেটা ব্যবহার করে তার জন্য নির্দিষ্ট ওষুধ বা চিকিৎসা পদ্ধতি নির্ধারণ করা সম্ভব হচ্ছে।
ওমিক্স ডেটার ব্যবহার শুধু চিকিৎসাশাস্ত্রে নয়, কৃষি এবং প্রাণিসম্পদ গবেষণায়ও ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, প্রাণিসম্পদের প্রজনন প্রক্রিয়ায় জেনোমিক্স এবং প্রোটিওমিক্স ব্যবহার করে উন্নত বংশ নির্বাচন করা হচ্ছে, যা উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করছে।
ওমিক্স ডেটা আধুনিক জীববিজ্ঞানে এক নতুন বিপ্লব ঘটাচ্ছে। এটি শুধু বিভিন্ন রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং কৃষি, প্রাণিসম্পদ, এবং পরিবেশ বিজ্ঞানেও এর ব্যবহার ক্রমাগত বাড়ছে। ভবিষ্যতে, ওমিক্স ডেটার মাধ্যমে আরও উন্নত এবং কার্যকর পদ্ধতিতে জীববিজ্ঞান এবং চিকিৎসা ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে বলে আশা করা যায়।
ডিএনএ (Deoxyribonucleic Acid) সম্পর্কে আমাদের প্রচলিত ধারণা মূলত ডাবল হেলিক্সের গঠনকেই কেন্দ্র করে, যা বিজ্ঞানী রোজালিন্ড ফ্রাঙ্কলিনের এক্স-রে ক্রিস্টালোগ্রাফি ছবি বিশ্লেষণ করে জেমস ওয়াটসন এবং ফ্রান্সিস ক্রিক ১৯৫৩ সালে আবিষ্কার করেন। তারা দেখান যে ডিএনএ দুটি সুতো দিয়ে তৈরি, যা একে অপরকে পেঁচিয়ে একটি সর্পিল আকৃতি গঠন করে। তবে সাম্প্রতিক এক গবেষণায় ডিএনএর একটি নতুন এবং রহস্যময় কাঠামো আবিষ্কৃত হয়েছে, যাকে বলা হচ্ছে i-motif। এটি ডাবল হেলিক্সের সাথে অনেকটাই ভিন্ন এবং এর আবিষ্কার জীববিজ্ঞানে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে।
i-motif
i-motif-এর ধারণা প্রথমবারের মতো ১৯৯০-এর দশকে উত্থাপিত হয়। ডিএনএর গঠন নিয়ে গবেষণা করার সময় বিজ্ঞানীরা পরীক্ষাগারে এটি দেখতে পান। তবে, এই কাঠামোটি জীবন্ত কোষে কখনও সনাক্ত করা হয়নি, ফলে বিজ্ঞানীদের মধ্যে সন্দেহ ছিল যে এটি বাস্তবে জীবন্ত কোষে বিদ্যমান কিনা। কারণ এটি খুব অস্থিতিশীল এবং ধারণা ছিল যে শরীরের স্বাভাবিক শারীরিক অবস্থায় এটি টিকে থাকতে পারবে না। তবে, ২০১৮ সালে অস্ট্রেলিয়ার গারভান ইনস্টিটিউট অফ মেডিক্যাল রিসার্চের গবেষকরা জীবন্ত মানব কোষে প্রথমবারের মতো i-motif সনাক্ত করেন। তারা একটি বিশেষ অ্যান্টিবডি তৈরি করেন যা শুধুমাত্র i-motif-এর সঙ্গে সংযুক্ত হয়, যার ফলে তারা সহজেই এই কাঠামোটি কোষে শনাক্ত করতে সক্ষম হন। এই অ্যান্টিবডির মাধ্যমে তারা দেখতে পান যে i-motif মানব কোষের বিভিন্ন অংশে উপস্থিত এবং এটি একটি সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে।
i-motif এবং ডাবল হেলিক্সের মধ্যে পার্থক্য
ডিএনএ-এর ডাবল হেলিক্স গঠন দুইটি সুতা নিয়ে গঠিত, যেখানে প্রতিটি সুতায় চারটি নিউক্লিওটাইড (Adenine, Thymine, Cytosine, এবং Guanine) নির্দিষ্ট নিয়ম অনুযায়ী জোড়া বাঁধে। Adenine (A) সর্বদা Thymine (T)-এর সাথে এবং Cytosine (C) সর্বদা Guanine (G)-এর সাথে জোড়া বাঁধে। এই সজ্জা ডিএনএর স্থায়িত্ব ও তথ্য সংরক্ষণের জন্য অপরিহার্য। অন্যদিকে, i-motif এর গঠন ডাবল হেলিক্সের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখানে, Cytosine (C) ভিত্তিগুলি একে অপরের সাথে সংযুক্ত হয়, সাধারণ G (Guanine) ভিত্তির পরিবর্তে। এই গঠনটি একটি ছোট গিঁটের মতো বাঁকানো অবস্থায় থাকে, যা ডাবল হেলিক্সের সোজা ও পেঁচানো গঠনের তুলনায় আলাদা। i-motif সাধারণত ডিএনএ-এর নির্দিষ্ট অঞ্চলে তৈরি হয়, বিশেষ করে যখন ডিএনএ-তে কম pH বা অ্যাসিডিক পরিবেশ বিদ্যমান থাকে। এই অবস্থায়, Cytosine ভিত্তিগুলি একে অপরের সাথে যুক্ত হয়ে একটি বিশেষ চার-স্তরের গঠন তৈরি করে। i-motif-এর একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো এর অস্থায়িত্ব এবং পরিবর্তনশীলতা। এটি কোষের পরিবেশের ওপর নির্ভর করে গঠিত হয় এবং সহজেই খুলে যায়। যখন পরিবেশ অ্যাসিডিক থাকে, তখন এটি গিঁটের মতো বাঁকানো থাকে, এবং যখন পরিবেশ স্বাভাবিক অবস্থায় থাকে, তখন এটি আবার খুলে যায়। এই অস্থায়িত্বের কারণেই i-motif কে ডাবল হেলিক্সের মতো স্থায়ী গঠন হতে আলাদা করে। ডাবল হেলিক্স সাধারণত পরিবেশগত পরিবর্তনের সাথে সহজেই পরিবর্তিত হয় না এবং এটি অনেক বেশি স্থিতিশীল।
i-motif এর গুরুত্ব
i-motif এর আবিষ্কার কেন এত গুরুত্বপূর্ণ? কারণ এটি আমাদের ডিএনএ নিয়ে প্রচলিত ধারণাগুলিকে সম্পূর্ণ নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করতে সাহায্য করছে। প্রথমত, এটি প্রমাণ করে যে ডিএনএ শুধু ডাবল হেলিক্সে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এর গঠন আরও বৈচিত্র্যময় হতে পারে। ডিএনএ’র এই নতুন গঠন জীবন্ত কোষের জিন নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়ার সাথে সরাসরি যুক্ত। i-motif সাধারণত এমন জায়গায় পাওয়া যায় যা জিন নিয়ন্ত্রণ এবং অভিব্যক্তিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি এমন একটি সুইচের মতো কাজ করতে পারে, যা নির্ধারণ করে কোন জিন সক্রিয় বা নিষ্ক্রিয় হবে। দ্বিতীয়ত, i-motif এর অ্যাসিডিক পরিবেশের উপর নির্ভরশীলতা এটিকে কোষের কাজ এবং বিকাশে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে। কোষের বিভিন্ন কাজ যেমন বিভাজন, বৃদ্ধির সময়, এবং জিনের নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়ায় pH বা অ্যাসিডিটির পরিবর্তন ঘটতে পারে। i-motif এই পরিবর্তনের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে সক্ষম, এবং এটি জিনের অভিব্যক্তি নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখতে পারে।
i-motif এর ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
i-motif এর আবিষ্কার ডিএনএ গবেষণায় নতুন দিক উন্মোচন করেছে। এটি শুধুমাত্র জিন নিয়ন্ত্রণে নয়, ভবিষ্যতে রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসা বিজ্ঞানেও নতুন সম্ভাবনার জন্ম দেবে। একটি সম্ভাবনা হল i-motif এর সাহায্যে জেনেটিক রোগ যেমন ক্যান্সার এবং অন্যান্য জিনগত রোগ নিয়ন্ত্রণ করা। যেহেতু এটি জিনের সক্রিয়তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, তাই এই কাঠামো ব্যবহার করে জিনের কার্যক্রম সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, ক্যান্সার কোষের অনিয়ন্ত্রিত বৃদ্ধি বন্ধ করতে i-motif এর সুইচিং পদ্ধতি ব্যবহার করা যেতে পারে। i-motif এর গবেষণা আরও উন্নত হলে, এটি ভবিষ্যতে জিন থেরাপি এবং জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। জেনেটিক রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসার ক্ষেত্রে এটি নতুন নতুন পথ উন্মোচন করবে বলে বিজ্ঞানীরা আশা করছেন।
সাইটেশন (Citation)
সাইটেশন হলো আপনি আপনার লেখায় যে তথ্য ব্যবহার করেছেন সেই তথ্য কোথা থেকে পেয়েছেন তা উল্লেখ করার পদ্ধতি। সাইট (Cite) করা মানে আপনার লেখার তথ্যের উৎস উল্লেখ করা। এটি পাঠকদের সঠিক ধারণা প্রদান করে যে আপনি কোন উৎস থেকে তথ্যগুলো সংগ্রহ করেছেন। শুধু তাই নয় এটি আপনার লেখার মান ও নির্ভরযোগ্যতা বৃদ্ধি করতে ও সহায়তা করে।
সাইটেশন এর গুরুত্ব
১. কৃতজ্ঞতা প্রকাশ: সাইটেশন দ্বারা আপনি অন্য লেখকের কাজের প্রশংসা করছেন এবং তাদের প্রচেষ্টার সঠিক স্বীকৃতি দিচ্ছেন।
২. প্রমাণ ভিত্তিক লেখনি: সাইটেশন আপনার লেখাকে বিশ্বাসযোগ্য এবং প্রমাণ ভিত্তিক করে তোলে।
৩. পাঠকের জন্য সাহায্য: সাইটেশন পাঠকদের প্রকৃত তথ্যের উৎস অনুসন্ধান করতে সাহায্য করে, যাতে তারা মূল উৎসটি সহজেই দেখতে পারে।
৪. প্লেজারিজম (Plagiarism) এড়ানো: সাইটেশন ব্যবহার করে আপনি অন্য কারো কাজকে আপনার নিজের বলে দাবি করা থেকে বিরত থাকেন যা প্লেজারিজম বা চুরির অপবাদের দায় এড়াতে সহায়তা করে।
রেফারেন্স (Reference)
রেফারেন্স হলো আপনার সমস্ত উৎসের বিস্তারিত তালিকা যা সাধারণত আপনার লেখার শেষে দেওয়া হয়। রেফারেন্স তালিকায় সাধারণত আপনার প্রতিটি তথ্যসূত্রের পূর্ণ বিবরণ থাকে যেমন লেখকের নাম, প্রকাশনার তারিখ, শিরোনাম, প্রকাশক এবং পৃষ্ঠা সংখ্যা ইত্যাদি।
রেফারেন্স এবং সাইটেশন একসাথে কাজ করে। সাইটেশন আপনার মূল লেখার মধ্যে সংক্ষিপ্তভাবে উল্লেখ করা থাকে এবং রেফারেন্স তালিকায় সেই উল্লেখগুলির বিস্তারিত বিবরণ দেয়া হয়। সাইটেশন হতে পারে কারো তথ্যের সরাসরি উদ্ধৃতি বা প্যারাফ্রেজিং (Paraphrasing) যেখানে আপনি অন্য কারো কথাকে নিজের ভাষায় উপস্থাপন করেছেন। রেফারেন্স এবং সাইটেশন এর বিভিন্ন ফরমেট রয়েছে, যেমন APA, MLA, Chicago ইত্যাদি।
প্রতিটি ফরমেটেরই নিজস্ব নিয়ম আছে যা লেখার ধরন এবং প্রতিষ্ঠানের ভিত্তিতে পরিবর্তিত হয়। রেফারেন্স এবং সাইটেশন সঠিকভাবে ব্যবহার করে আপনি আপনার লেখাকে আরও গ্রহণযোগ্য এবং নির্ভরযোগ্য করতে পারেন।
রেফারেন্সের গুরুত্ব
১. সম্পূর্ণ তথ্য প্রদান: রেফারেন্স পাঠকদের আপনার ব্যবহৃত উৎসের সম্পূর্ণ তথ্য প্রদান করে যাতে তারা সেই উৎস গুলি খুঁজে পেতে পারে।
২. পাঠকের জন্য অনুসন্ধান সহজ করা: রেফারেন্স তালিকা পাঠকদের অনুসন্ধান সহজ করে তোলে এবং তারা সহজে উৎস গুলি খুঁজে পেতে পারে।
৩. পুনঃপরীক্ষার সুযোগ: রেফারেন্স তালিকা অন্য গবেষকদের আপনার তথ্য পুনঃপরীক্ষা করতে এবং আপনার গবেষণার উপর ভিত্তি করে তাদের নিজস্ব গবেষণা চালাতে সাহায্য করে।
৪. একাডেমিক সততা: রেফারেন্স তালিকা ব্যবহার করে আপনি একাডেমিক সততা বজায় রাখেন।
যখন একজন গবেষক অন্য একজন গবেষক এর গবেষণাপত্র থেকে তথ্য ব্যবহার করে, তখন তাদের লেখায় সাইটেশন সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। ধরা যাক আপনি একটি গবেষণা পেপার (Research article) লিখেছেন এবং সেই পেপার হতে অন্য ১০০ জন গবেষক আপনার এই পেপার থেকে তথ্য নিয়ে নিজেরা কাজ করেছেন। তাহলে আপনার লেখার সাইটেশন সংখ্যা হবে ১০০।
বর্তমানে অনেকেই অনেক সময় জার্নালের ইম্প্যাক্ট ফ্যাক্টর এবং সাইটস্কোর সম্পর্কে প্রশ্ন করে থাকে। এই মেট্রিক গুলো দ্বারা কি বোঝায় সে সম্পর্কে অনেকেরই মনে একটু অস্পষ্টতা বিদ্যমান।
ইম্প্যাক্ট ফ্যাক্টর এবং সাইটস্কোর হল জনপ্রিয় দুটি উপায় যা একাডেমিক জার্নালের গুরুত্ব এবং মান পরিমাপ করতে ব্যবহৃত হয়। এই পরিমাপগুলো গবেষক, প্রতিষ্ঠান এবং পাঠকদের বুঝতে সাহায্য করে যে একটি জার্নালে প্রকাশিত রিসার্চ পেপারগুলো কতবার অন্যদের দ্বারা সাইটেশন (Citation) হয়েছে।
ইম্প্যাক্ট ফ্যাক্টর (Impact Factor)
ড. ইউজিন গারফিল্ড (Dr. Eugene Garfield) গবেষণার মান এবং গুরুত্ব পরিমাপ করার জন্য ১৯৬০ দশকের দিকে সর্বপ্রথম ইম্প্যাক্ট ফ্যাক্টর ধারণার প্রবর্তন করেন। এজন্য তিনি ইনস্টিটিউট ফর সাইন্টিফিক ইনফরমেশন (ISI) প্রতিষ্ঠা করেন যা পরবর্তীতে ক্লারিভেট (Clarivate) হিসেবে গড়ে ওঠে। এই পরিমাপটি বর্তমানে ক্লারিভেট অ্যানালিটিক্স দ্বারা প্রদান করা হয় যা জার্নাল সাইটেশন রিপোর্টস (JCR) এর মাধ্যমে পাওয়া যায়।
কোন জার্নালের ইম্প্যাক্ট ফ্যাক্টর নির্ণয় করা হয় গত দুই বছরে প্রকাশিত রিসার্চ পেপারের মোট সাইটেশন সংখ্যা এবং উক্ত জার্নালে সেই দুই বছরের মধ্যে প্রকাশিত মোট রিসার্চ পেপারের সংখ্যার অনুপাত দ্বারা। এখানে শুধুমাত্র নির্দিষ্ট ধরনের রিসার্চ পেপার যেমন গবেষণাপত্র এবং পর্যালোচনা প্রবন্ধ বিবেচনা করা হয়।
যেমন ধরুন একটি জার্নালে ২০২১ এবং ২০২২ সালে সর্বমোট প্রকাশিত রিসার্চ পেপারের সাইটেশন সংখ্যা ৮৫০ এবং উক্ত জার্নালে ওই দুই বছরে প্রকাশিত মোট রিসার্চ পেপারের সংখ্যা ১১৫।
তাহলে ইম্প্যাক্ট ফ্যাক্টর = (২০২১ এবং 2022 সালে প্রকাশিত রিসার্চ পেপারের মোট সাইটেশন সংখ্যা) / (২০২১ এবং ২০২২ সালে প্রকাশিত মোট রিসার্চ পেপারের সংখ্যা)
= ৮৫০/১১৫ = ৭.৩৯
সাইটস্কোর (CiteScore)
ইম্প্যাক্ট ফ্যাক্টরের তুলনায় সাইটস্কোর তুলনামূলকভাবে নতুন একটি গাণিতিক পরিমাপ, যা ২০১৬ সালে এলসেভিয়ার (Elsevier) কর্তৃক চালু করা হয়। এর উদ্দেশ্য ছিল আরো বিস্তৃত এবং স্বচ্ছ একটি মেট্রিক প্রদান করা যা গবেষণার দীর্ঘ মেয়াদী প্রভাব মূল্যায়ন করতে পারে।
এই পরিমাপটি এলসেভিয়ারের স্কোপাস ডাটাবেজ দ্বারা প্রদান করা হয়। সাইটস্কোর নির্ণয় করা হয় মূলত কোন জার্নালে তিন বছরে প্রকাশিত রিসার্চ পেপারের ভিত্তিতে। ধরুন কোন জার্নালে ২০২০, ২০২১ এবং ২০২২ সালে প্রকাশিত রিসার্চ পেপারের মোট সাইটেশন সংখ্যা ১০৭০ এবং সেই তিন বছরে উক্ত জার্নালে প্রকাশিত মোট রিসার্চ পেপারের সংখ্যা ১৫৫।
তাহলে সাইটস্কোর = ১০৭০/১৫৫ = ৬.৯০
ইম্প্যাক্ট ফ্যাক্টরের তুলনায় সাইটস্কোরে আরো বেশি ধরনের ডকুমেন্ট বিবেচনা করা হয় যেমন গবেষণাপত্র, পর্যালোচনা প্রবন্ধ, কনফারেন্স পেপার, বইয়ের অধ্যায় এবং ডাটা পেপার।
কেন এটি গুরুত্বপূর্ণ?
ইম্প্যাক্ট ফ্যাক্টর এবং সাইটস্কোর উভয়ই জার্নালের গুণগত মান এবং গুরুত্ব নির্ণয়ে মূল্যবান তথ্য প্রদান করে। ইম্প্যাক্ট ফ্যাক্টর মূলত কোন জার্নালের স্বল্পমেয়াদী মান বুঝার জন্য উপযোগী, কিন্তু সাইটস্কোর আরো বিস্তৃত তথ্য প্রদান করে, কারণ এতে দীর্ঘ সময়কাল এবং বেশি ধরনের ডকুমেন্ট বিবেচিত হয়।
বিশ্বব্যাপী গবেষণা এবং প্রকাশনার ক্ষেত্রে Science Citation Index Expanded (SCIE), Social Sciences Citation Index (SSCI), Arts & Humanities Citation Index (AHCI) এবং Emerging Sources Citation Index (ESCI) অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সূচক। এই সূচকগুলো গবেষণা প্রবন্ধের মান এবং গ্রহণযোগ্যতা যাচাই করতে ব্যবহৃত হয়।
Science Citation Index Expanded (SCIE)
Dr. Eugene Garfield ১৯৬৪ সালে Science Citation Index (SCI)-এর সূচনা করেন। এটি প্রথমে বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার গবেষণাপত্রের মান এবং গুরুত্ব নির্ধারণের জন্য প্রবর্তিত হয়। পরবর্তীতে ১৯৯৭ সালে এটি Science Citation Index Expanded (SCIE) নামে পরিচিতি লাভ করে। SCIE-এর ইনডেক্সিং ডেটাবেসে ১৯০০ সাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত ১৭৮টি বিষয়ে ৯,২০০-এরও বেশি উল্লেখযোগ্য এবং গুরুত্বপূর্ণ জার্নাল অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এই জার্নালগুলোকে বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত ক্ষেত্রে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় জার্নাল হিসেবে বিবেচনা করা হয়। SCIE জার্নালগুলোতে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, চিকিৎসা, প্রকৌশল, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন এবং জীববিজ্ঞানসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ শাখার গবেষণা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
Social Sciences Citation Index (SSCI)
মূলত সামাজিক বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় গবেষণাপত্রের citation-এর ভিত্তিতে তার গুরুত্ব মূল্যায়ন করার জন্য ১৯৭২ সালে Social Sciences Citation Index (SSCI) প্রবর্তিত হয়। SSCI ক্লারিভেট অ্যানালিটিক্সের একটি বাণিজ্যিক সাইটেশন ইনডেক্স। এটি মূলত Science Citation Index থেকে Institute for Scientific Information দ্বারা তৈরি করা হয়েছিল। এই সূচক ডেটাবেসটি ১৯৮৫ সাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত ৫৮টি শাখার ৩,৪০০-এরও বেশি জার্নালকে অন্তর্ভুক্ত করে। এর মধ্যে সমাজবিজ্ঞান, অর্থনীতি, আইন, রাজনীতি, মনোবিজ্ঞান, শিক্ষা, জনস্বাস্থ্য এবং অন্যান্য সামাজিক বিজ্ঞানের শাখা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
Arts & Humanities Citation Index (AHCI)
Institute for Scientific Information (ISI) দ্বারা প্রকাশিত Arts & Humanities Citation Index (AHCI) ১৯৭৫ সালে প্রবর্তিত হয়। এটি মূলত শিল্পকলা এবং মানববিদ্যার বিভিন্ন শাখার গবেষণাপত্রের মূল্যায়নের উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়। সাহিত্য, ইতিহাস, দর্শন, শিল্পকলা, ভাষাতত্ত্ব, সংগীত এবং অন্যান্য মানবিক শাখার অন্তর্ভুক্ত প্রায় ১,৮০০-এরও বেশি জার্নালকে অন্তর্ভুক্ত করে AHCI। এই ডেটাবেসটি অনলাইনে Web of Science এর মাধ্যমে অ্যাক্সেস করা যায়।
Emerging Sources Citation Index (ESCI)
Emerging Sources Citation Index (ESCI) ২০১৫ সাল থেকে Thomson Reuters দ্বারা প্রযোজিত একটি সাইটেশন ইনডেক্স, যা বর্তমানে Clarivate দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। এই ইনডেক্সে প্রতিনিধিত্বশীল ও আঞ্চলিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এবং উদীয়মান বৈজ্ঞানিক ক্ষেত্রের পিয়ার-রিভিউড প্রকাশনাগুলি অন্তর্ভুক্ত করা হয়। অন্যান্য Clarivate সূচকের সাথে ESCI অন্তর্ভুক্ত জার্নালগুলো Web of Science এর মাধ্যমে অ্যাক্সেসযোগ্য। জুন ২০২১ থেকে ESCI-তে অন্তর্ভুক্ত সকল জার্নাল Journal Citation Reports (JCR) এ অন্তর্ভুক্ত হয়। যদিও এই জার্নালগুলো সেই সময় পর্যন্ত ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর পায়নি, তবে তারা অন্যান্য জার্নালের ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর গণনার জন্য সাইটেশন প্রদানে ভূমিকা রাখে। জুলাই ২০২২-এ Clarivate ঘোষণা করে যে ESCI-তে অন্তর্ভুক্ত জার্নালগুলো JCR Year 2022 থেকে ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর পাবে, যা প্রথমবার জুন ২০২৩-এ প্রকাশিত হয়।
জার্নাল কোয়ার্টাইল (Q) র্যাংকিং প্রকাশনার গুণগত মান নির্ধারণের একটি পরিসংখ্যানগত পদ্ধতি। এটি জার্নাল র্যাংকিংয়ের একটি প্যারামিটার হিসেবেও পরিচিত। গবেষণার মানের উপর ভিত্তি করে এই র্যাংকিং সিস্টেম চারটি কোয়ার্টাইলে ভাগ করা হয়: Q1, Q2, Q3 এবং Q4। এই র্যাংকিংয়ের মূল ভিত্তি হলো ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর (IF), সাইটেশন (Citation), এবং নির্দিষ্ট জার্নালের ইনডেক্সিং।
কোয়ার্টাইল র্যাংকিং প্রতিটি জার্নালের সংশ্লিষ্ট বিষয়ের ক্যাটাগরির উপর ভিত্তি করে নির্ধারিত হয় এবং ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর অনুযায়ী কোন কোয়ার্টাইলে সেই জার্নালটি অবস্থান করছে তা নির্ধারণ করে। কোয়ার্টাইল র্যাংক নির্ধারণের জন্য একটি বিভাগের জার্নালগুলির ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর বা অন্যান্য গুণগত সূচক ব্যবহার করে তাদের র্যাংক নির্ধারণ করা হয়। এই র্যাংকিং সিস্টেমটি পরিমাপ করে কত শতাংশ জার্নাল ঐ বিভাগে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
কোয়ার্টাইলের বিভিন্ন ভাগ
Q1: শীর্ষ ২৫% জার্নাল।
Q2: Q1 এর পরে শীর্ষ ২৫% থেকে ৫০% পর্যন্ত জার্নাল।
Q3: Q2 এর পরে ৫০% থেকে ৭৫% পর্যন্ত জার্নাল।
Q4: শেষ বা সর্বনিম্ন ২৫% জার্নাল (৭৫% থেকে ১০০% পর্যন্ত)।
কোয়ার্টাইল র্যাংকিং নির্ণয় করার পদ্ধতি
Q1: 0% < Z ≤ 25% কোন বিভাগের সর্বোচ্চ র্যাংকিং জার্নাল
Q2: 25% < Z ≤ 50%
Q3: 50% < Z ≤ 75%
Q4: 75% < Z কোন বিভাগের সর্বনিম্ন র্যাংকিং জার্নাল
এখানে ,
Z = (X/Y)
X = কোন নির্দিষ্ট বিভাগের মধ্যে ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর অনুযায়ী জার্নালের অবস্থান
Y = ঐ বিভাগে মোট জার্নালের সংখ্যা
উদাহরণ
ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর অনুযায়ী সাজানো হলে যদি কোনো জার্নাল নির্দিষ্ট কোনো বিভাগে মোট ৩০০টি জার্নালের মধ্যে ৭০ নম্বর র্যাংকে অবস্থান করে তাহলে Z = (৭০/৩০০) = ০.২৩৩ (২৩.৩%) যা Q1 জার্নাল।
ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর অনুযায়ী যদি একটি জার্নাল কোনো বিভাগে মোট ২০৪টির মধ্যে ১০২ নম্বর র্যাংকে অবস্থান করে তাহলে Z = (১০২/২০৪) = ০.৫ (৫০%) যা Q2 জার্নাল।
জার্নালের কোয়ার্টাইল র্যাংকিং দেখতে চাইলে এখানে ক্লিক করতে পারেন: https://www.scimagojr.com/journalrank.php
এই ওয়েবসাইটে যদি আপনি নির্দিষ্ট কোনো জার্নাল সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানতে চান, তাহলে সংশ্লিষ্ট জার্নালের শিরোনামে ক্লিক করে আপনি সেই জার্নালটির বিস্তারিত তথ্য দেখতে পাবেন এবং নির্দিষ্ট জার্নালের সমস্ত তথ্য পাবেন।
গবেষণার ক্ষেত্র যত বড় হচ্ছে, ততই গবেষকদের সঠিক পরিচয় এবং কাজের স্বীকৃতি প্রদান খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বিশ্বের বড় বড় প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান, গবেষণা সংস্থা এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এই সমস্যা সমাধানের জন্য একটি নির্ভরযোগ্য পরিচয় ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। এই প্রয়োজন পূরণের লক্ষ্যে ২০১০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ডেলাওয়্যারে ORCID (Open Researcher and Contributor Identifier) প্রতিষ্ঠিত হয়।
ORCID একটি অ-লাভজনক সংস্থা, যার প্রধান লক্ষ্য হলো প্রতিটি গবেষককে একটি অনন্য (Unique) আইডি প্রদান করা, যা তাদের প্রকাশনা, গবেষণা এবং অবদানকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করে। ORCID শুধু গবেষকদের জন্য নয়, প্রকাশক এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্যও গুরুত্বপূর্ণ একটি টুল। বিভিন্ন প্রকাশনা এবং গবেষণা প্রকল্পে গবেষকদের অবদান সঠিকভাবে ট্র্যাক করতে এবং তাদের কাজের যথাযথ স্বীকৃতি দিতে ORCID ব্যবহৃত হয়। এটি গবেষণার মান উন্নয়ন এবং গবেষকদের সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে সহায়ক। যে কেউ ORCID এর ওয়েবসাইটে (https://orcid.org/) গিয়ে বিনামূল্যে নিবন্ধন করে তার আইডি তৈরি করতে পারেন।
ORCID কেন গুরুত্বপূর্ণ?
১. একক পরিচয় (Unique Identity)
একই নামের গবেষকরা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে যুক্ত থাকলে কখনও কখনও নামের মিল বা ভিন্নভাবে লেখা নিয়ে বিভ্রান্তি হতে পারে। ORCID প্রতিটি গবেষককে একটি বিশেষ আইডি প্রদান করে যা নিশ্চিত করে যে তাদের কাজ সঠিকভাবে তাদের প্রোফাইলে থাকবে এবং নামের কারণে অন্যের কাজ ভুলভাবে যুক্ত হবে না।
২. গবেষণা কাজের সঠিক সাইটেশন
ORCID আইডির সাহায্যে গবেষকদের কাজ সঠিকভাবে চিহ্নিত করা হয়। এর মাধ্যমে গবেষণা সংস্থা ও প্রকাশকরা গবেষকদের সঠিকভাবে চিহ্নিত করতে পারে এবং তাদের কাজের সঠিক স্বীকৃতি নিশ্চিত করে, যা ভুল সাইটেশনের সমস্যা কমিয়ে দেয়।
৩. গবেষণা কাজের একীভূত প্রোফাইল
গবেষকরা বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে তাদের গবেষণার কাজ প্রকাশ করে থাকেন, যেমন গুগল স্কলার, রিসার্চ গেট, ওয়েব অফ সায়েন্স ইত্যাদি। ORCID ব্যবহার করে তারা একটি কেন্দ্রীয় প্রোফাইল তৈরি করতে পারেন, যেখানে তাদের সমস্ত কাজ একসঙ্গে দেখা যায়। এর ফলে তাদের কাজের একটি সম্পূর্ণ চিত্র পাওয়া যায়।
৪. বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত এবং গ্রহণযোগ্য
ORCID আন্তর্জাতিকভাবে গৃহীত একটি পরিচয় নম্বর যা বিশ্বের বড় বড় গবেষণা প্রতিষ্ঠান, প্রকাশনা সংস্থা ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ব্যবহার করে। এটি গবেষকদের কাজকে বৈশ্বিক স্বীকৃতি দেয়।
ORCID আইডি কিভাবে কাজ করে?
ORCID আইডি মূলত একটি লিংক বা URL আকারে থাকে। উদাহরণস্বরূপ, একজন গবেষকের ORCID হতে পারে: https://orcid.org/0000-0002-5158-4558। তবে অনেক সময় শুধু "ORCID: 0000-0002-5158-4558" আকারেও এটি ব্যবহার করা হয়।
ORCID ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ড নেম আইডেন্টিফায়ার (ISNI)-এর একটি অংশ। ISNI বিভিন্ন ধরণের অবদানকারীদের, যেমন লেখক বা টিভি প্রোগ্রামের নির্মাতাদের চিহ্নিত করতে ব্যবহৃত হয়। ORCID এর জন্য ISNI কিছু নম্বর বরাদ্দ করেছে, যেমন 0000-0001-5000-0007 থেকে 0000-0003-5000-0001 পর্যন্ত। তাই, একজন ব্যক্তি একই সাথে দুটি আইডি পেতে পারেন, যা কার্যত ISNI এবং ORCID উভয়েরই সমতুল্য।
ORCID এবং ISNI আইডি ১৬টি সংখ্যা নিয়ে গঠিত, যেখানে প্রতি চারটি সংখ্যার পর একটি হাইফেন থাকে। এই আইডির শেষ সংখ্যাটি বিশেষ চেক ডিজিট দিয়ে নিশ্চিত করা হয় যে আইডিটি সঠিক। উদাহরণস্বরূপ, Stephen Hawking-এর ORCID নম্বর হচ্ছে: https://orcid.org/0000-0002-9079-593X।
মানব সভ্যতার ইতিহাসে তথ্য সংরক্ষণের গুরুত্ব অপরিসীম। প্রাচীনকালের মাটির পাত্র, পাথরের ফলক, এবং প্যাপিরাস থেকে শুরু করে আধুনিক যুগের ক্লাউড স্টোরেজ—তথ্য সংরক্ষণের পদ্ধতিগুলি যুগে যুগে বিবর্তিত হয়েছে। ১৮৯০ সালে পাঞ্চ কার্ডের আবিষ্কার থেকে শুরু হওয়া এই যাত্রা পরবর্তীতে বিভিন্ন প্রযুক্তির হাত ধরে এগিয়ে চলেছে, যেমন ১৯৩২ সালে ম্যাগনেটিক ড্রাম, ১৯৪৭ সালে উইলিয়ামস-কিলবার্ন টিউব, ১৯৫১ সালে ম্যাগনেটিক টেপ ড্রাইভ এবং ম্যাগনেটিক কোর, ১৯৫৬ সালে হার্ড ডিস্ক ড্রাইভ (HDD), ১৯৬৭ সালে ফ্লপি ডিস্ক, ১৯৮২ সালে কমপ্যাক্ট ডিস্ক (CD), ১৯৯৪ সালে জিপ ড্রাইভ, এবং ১৯৯৫ সালে ডিজিটাল ভিডিও ডিস্ক (DVD)। এই ডিভাইসগুলো ছিল আকারে বড় এবং কম মেমোরি ধারণক্ষমতাসম্পন্ন।
বর্তমানে আমরা যে হার্ডডিস্ক, মেমোরি কার্ড, বা ক্লাউড স্টোরেজ ব্যবহার করছি, তা দিনে দিনে ছোট থেকে ছোটতর হলেও তথ্যের পরিমাণ এতটাই বৃদ্ধি পাচ্ছে যে, এগুলোর ধারণক্ষমতার সীমা শীঘ্রই অতিক্রম করবে। বর্তমান পৃথিবীতে প্রতিদিন যে পরিমাণ ডিজিটাল ডাটা তৈরি হচ্ছে, তা সামলানো ভবিষ্যতে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে। ২০২০ সালের পর থেকে ডাটার আকার এতটাই দ্রুতগতিতে বাড়ছে যে, ২০৪০ সালের মধ্যে এটি প্রায় ১৬০ জেটাবাইটে পৌঁছাতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে (১ জেটাবাইট = ১ বিলিয়ন টেরাবাইট = ১ ট্রিলিয়ন গিগাবাইট)। এত বিশাল পরিমাণ তথ্য সংরক্ষণের জন্য আমাদের কাছে এখনকার প্রযুক্তির বাইরে নতুন সমাধান দরকার।
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা আমাদের নিজস্ব জিনগত উপাদান—ডিএনএ’র দিকে নজর দিয়েছেন। ডিএনএ (ডিঅক্সিরাইবো নিউক্লিক অ্যাসিড) আমাদের দেহের জীববৈশিষ্ট্য সংরক্ষণ করে রাখে এবং এই ডিএনএ তে থাকে প্রচুর পরিমাণ তথ্য সংরক্ষণের সক্ষমতা। ডিএনএ তে তথ্য সংরক্ষণের ধারণাটি অনেক প্রাচীন এবং মজবুত, যা প্রকৃতির কঠিন পরীক্ষায় টিকে থাকতে সক্ষম। মাত্র ১ গ্রাম ডিএনএতে ২১৫ পেটাবাইট (১ পেটাবাইট = ১০০০ টেরাবাইট) তথ্য সংরক্ষণ করা সম্ভব। তুলনা করলে দেখা যায় যেখানে একটি আধুনিক হার্ডডিস্ক মাত্র কয়েক টেরাবাইট তথ্য ধারণ করতে পারে, সেখানে ডিএনএ’র মধ্যে একই পরিমাণ স্থান ব্যবহারে অনেক গুণ বেশি তথ্য সংরক্ষণ করা যায়। এছাড়া, প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতার কারণে ডেটা হারানোর ঝুঁকি থাকে, কিন্তু ডিএনএ হাজার হাজার বছর ধরে নির্ভুলভাবে তথ্য সংরক্ষণ করতে পারে। প্রাচীন বরফের নিচে থাকা জীবাশ্ম বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করেছেন যে, ডিএনএ হাজার হাজার বছর ধরে অক্ষত থাকতে পারে।
ডিএনএ’র গঠন বুঝতে হলে জানা প্রয়োজন এর মৌলিক উপাদানগুলি। ডিএনএ জীবের বংশগতির ধারক এবং বাহক। ডিএনএ’র অণুগুলি দুটি লম্বা সুতোর মতো একে অপরকে জড়িয়ে থাকে। যখন এই সুতোর মতো কুণ্ডলিত ডিএনএ হিস্টোন নামক প্রোটিন দিয়ে মোড়ানো থাকে, তখন এটি ক্রোমোজোম নামে পরিচিত। জীব কোষের নিউক্লিয়াসের ভিতরের এই ক্রোমোজোমে মূলত ডিএনএ অবস্থান করে। ডিএনএ জীবজগতের সমস্ত বৈশিষ্ট্য ধারণ করে এবং বংশ পরম্পরায় তা বহন করে।
এই ডিএনএ মূলত চারটি নাইট্রোজেন বেস (A, G, C, T) দ্বারা গঠিত যা একে অপরের সাথে সংযুক্ত হয়ে জিনগত তথ্য ধারণ করে। একটি পূর্ণাঙ্গ মানব কোষে প্রায় তিন বিলিয়নেরও বেশি নিউক্লিওটাইড থাকে, যা মিলিত হয়ে ডিএনএ গঠন করে। মানবদেহে মোট প্রায় ৩৭.২ ট্রিলিয়ন কোষ বিদ্যমান। যেহেতু ডিএনএ’তে থাকা এই বেসগুলো একটি নির্দিষ্ট সিকোয়েন্সে থাকে, তাই এগুলোকে যদি ০ এবং ১ এর মতো বাইনারি কোডে রূপান্তর করা যায়, তবে ডিজিটাল ডাটা সহজেই ডিএনএ’তে সংরক্ষণ করা সম্ভব।
ডিএনএ’তে তথ্য সংরক্ষণ করতে হলে প্রথমে ডিজিটাল ডাটাকে বাইনারি সিস্টেমে (০ এবং ১) রূপান্তর করতে হবে। এরপর সেই বাইনারি সিস্টেমকে ডিএনএ’র নিজস্ব বেস A, G, C, T তে রূপান্তর করতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, যদি A = ০০, G = ০১, C = ১০ এবং T = ১১ হয়, তবে ০১১১১০১০১১০০১১০১ স্ট্রিংটি রূপান্তরিত হবে GTCCTATG তে। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যেকোনো ডিজিটাল তথ্যকে ডিএনএ’তে সংরক্ষণ করা সম্ভব।
যদিও এই প্রক্রিয়াটি তাত্ত্বিকভাবে সহজ মনে হয়, বাস্তবে তা অত্যন্ত জটিল। প্রথমত, ডিএনএ সিকোয়েন্সিং প্রক্রিয়াটি এখনো অত্যন্ত ব্যয়বহুল। এর পাশাপাশি, কোন একটি নির্দিষ্ট ডাটা খুঁজে বের করতে হলে পুরো ডিএনএ সিকোয়েন্সিং করতে হবে, যা সময়সাপেক্ষ এবং কঠিন কাজ। এছাড়াও, ডিএনএ ডাটা স্টোরেজের জন্য সঠিক প্রযুক্তিগত অ্যালগরিদম ও ডিকোডিং প্রক্রিয়া এখনো উন্নয়নের অপেক্ষায় রয়েছে।
ডিএনএ’তে তথ্য সংরক্ষণের ধারণাটি নতুন মনে হলেও, এর উপর গবেষণা চলছে বিগত কয়েক দশক ধরে। ১৯৯৯ সালে নিউ ইয়র্কের বিজ্ঞানীরা সর্বপ্রথম ডিএনএ’তে একটি ছোট চিঠি সংরক্ষণ করেন এবং তা সফলভাবে পুনরায় ডিকোড করেন। ২০০৯ সালে কানাডার গবেষকগণ ২০০ বাইটের একটি ছোটদের ছড়ার ছবি, লেখা এবং অডিও ফাইল ডিএনএতে সংরক্ষণ করেন। ২০১২ সালে ব্রিটিশ বিজ্ঞানীরা উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের ১৫৪ টি সনেট এবং মার্টিন লুথার কিং এর বিখ্যাত “আই হ্যাভ এ ড্রিম” বক্তৃতার কিছু অংশের লেখা ডিএনএ তে সংরক্ষণ করতে সক্ষম হন। ২০১৬ সালে মাইক্রোসফ্ট এবং ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা ২০০ মেগাবাইটের ডিজিটাল ডাটা ডিএনএ’তে রূপান্তর করে নতুন রেকর্ড গড়েন।
সম্প্রতি, ক্যালিফোর্নিয়ার তরুণ গবেষক নাথানিয়েল রকে এবং হিউনজুন পার্ক ডিএনএ’তে তথ্য সংরক্ষণের একটি নতুন পদ্ধতি নিয়ে কাজ করছেন। তারা একটি স্টার্ট-আপ প্রতিষ্ঠা করেছেন, যা ডিএনএ তৈরি ও সিকোয়েন্সিং প্রক্রিয়াটিকে আরও সাশ্রয়ী করার চেষ্টা করছে। তাদের উদ্ভাবিত পদ্ধতিতে প্রি-ফ্যাব্রিকেটেড ডিএনএ তৈরি করা হয় এবং এনজাইম দ্বারা সেই ডিএনএ কে নির্দিষ্ট মেসেজে এনকোড করা হয়। এতে এই প্রক্রিয়াটি অনেক কম খরচে সম্পন্ন করা সম্ভব। ইতিমধ্যে তারা প্রথম কিলোবাইট এনকোডিং সফলভাবে সম্পন্ন করেছেন।
ডিএনএ’র মাধ্যমে তথ্য সংরক্ষণের এই প্রযুক্তি এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে থাকলেও অদূর ভবিষ্যতে এটি আমাদের পুরো ডিজিটাল দুনিয়ার তথ্য সংরক্ষণের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হয়ে উঠতে পারে। ডিএনএতে তথ্য সংরক্ষণের এই প্রযুক্তি যদি কার্যকরভাবে প্রয়োগ করা যায়, তবে এটি বিপুল পরিমাণ তথ্য সংরক্ষণের ক্ষেত্রে একটি যুগান্তকারী সমাধান হয়ে উঠবে, যা আমাদের ডিজিটাল ভবিষ্যৎকে আরো উন্নত ও নিরাপদ করবে।
জিনোম বলতে কোন জীবের সামগ্রিক ডিএনএ (DNA) কে বোঝায়। জীবজগতের বংশগতির ধারক ও বাহক হলো এই ডিএনএ। এর মাধ্যমেই জীবের বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পায়। জিনোম সিকোয়েন্সের প্রযুক্তি আজকের এই পর্যায়ে আসার পেছনে রয়েছে বিজ্ঞানীদের দীর্ঘ দিনের অক্লান্ত পরিশ্রম।
সেল নিউক্লিয়াসে ‘নিউক্লিন’ (বর্তমানে ডিএনএ হিসাবে পরিচিত) এবং এর সাথে যুক্ত প্রোটিনের উপস্থিতি চিহ্নিত করে ১৮৭১ সালে ফ্রেড্রিক মিয়েশ্চার (Friedrich Miescher) একটি প্রকাশনা প্রকাশ করেন।
ওয়াল্টার সুতন (Walter Sutton) এবং থিওডর বোভেরি (Theodor Boveri) বংশগতির ক্রোমোজোম তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে ১৯০৪ সালে প্রস্তাব দিয়েছিলেন যে ক্রোমোজোমগুলির মিলন জোড়ায় ঘটে অর্থাৎ একটি মায়ের কাছ থেকে এবং একটি পিতার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত হয়।
জার্মান বায়োকেমিস্ট অ্যালব্রেক্ট কোসেল (Albrecht Kossel) সর্ব প্রথম পাঁচটি জৈব যৌগের বিবরণ দিয়েছিলেন যা নিউক্লিক এসিডে উপস্থিত রয়েছে। এই যৌগ গুলোর নাম হল এডেনিন (A), সাইটোসিন (C), গুয়ানিন (G), থায়ামিন (T) এবং ইউরাসিল (U)। এই যৌগগুলি পরবর্তীতে সমস্ত জীব কোষে প্রাপ্ত জিনগত উপাদান ডিএনএ এবং আরএনএ গঠনের মূল উপাদান হিসেবে গবেষণায় প্রমাণিত হয়। এই গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারের জন্য অ্যালব্রেক্ট কোসেলকে ১৯১০ সালে ফিজিওলজি/মেডিসিনে প্রথম নোবেল পুরষ্কার দেওয়া হয়।
এরউইন চারগাফ (Erwin Chargaff) ১৯৫০ সালে দেখতে পান যে থায়ামিন (T) ও এডেনিন (A), এবং সাইটোসিন (C) ও গুয়ানিনের (G) ঘনত্ব সর্বদা ডিএনএর নমুনায় সমান পরিমাণে পাওয়া যায়। এইজন্য তিনি প্রস্তাব করেন যে ডিএনএ অণুর ভেতরে A সর্বদা জোড় বেঁধে থাকে T এর সাথে, আর C সর্বদা জোড় বেঁধে থাকে G এর সাথে।
১৯৫২ সালে আলফ্রেড হার্শি (Alfred Hershey) এবং মার্থা চেজ (Martha Chase) পরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণ করেন যে প্রোটিন নয়, ডিএনএ ই আমাদের জিনগত তথ্য বহন করে। এইজন্য এটা হার্শ-চেজ পরীক্ষা নামে পরিচিত।
১৯৫৩ সালে জেমস ওয়াটসন (James Watson) এবং ফ্রান্সিস ক্রিক (Francis Crick) ডিএনএ-র ডাবল হিলিক্স কাঠামোটি আবিষ্কার করেন। এই ডাবল হিলিক্স কাঠামোটি তৈরী হয়েছে ডি অক্সি রাইবোস, ফসফেট এবং চার ধরণের নাইট্রোজেন বেইস (base) দিয়ে। পরবর্তীতে এই আবিষ্কারের জন্য জেমস ওয়াটসন, ফ্রান্সিস ক্রিক এবং ফ্রেডেরিক উইলকিন্স (Frederick Wilkins) ১৯৬২ সালে ফিজিওলজি/মেডিসিনে নোবেল পুরষ্কার লাভ করেন।
মার্শাল নীরেনবার্গ (Marshall Nirenberg), হর গোবিন্দ খোরানা (Har Gobind Khorana) এবং তার সহকর্মীরা ১৯৬১ সালে সনাক্ত করে কীভাবে ডিএনএ-র বর্ণগুলি "কোডন" নামক তিনটি ব্লকের মধ্যে পড়ে এবং প্রতিটি কোডন একটি অ্যামিনো অ্যাসিড নির্দিষ্ট করে যা সংশ্লেষণের সময় প্রোটিনে যুক্ত হয়। এটাকে জীবনের কোড (Code for life) ও বলা হয়। এই কোডন আবিষ্কারের জন্য ১৯৬৮ সালে মার্শাল নীরেনবার্গ, হর গোবিন্দ খোরানা এবং রবার্ট হোলি কে ফিজিওলজি/মেডিসিনে নোবেল পুরষ্কার দেওয়া হয়।
ফ্রেডরিক স্যাঙ্গার (Frederick Sanger) ১৯৭৭ সালে একটি ডিএনএ সিকোয়েন্সিং কৌশল তৈরি করেন যা দিয়ে তিনি এবং তাঁর দল প্রথম phiX174 নামে একটি ভাইরাসের পূর্ণাঙ্গ জিনোম সিক্যুয়েন্স করতে সক্ষম হন। ফ্রেডরিক স্যাঙ্গার ডিএনএ সিকোয়েন্সিং পদ্ধতির পথিকৃতের জন্য ওয়ালি গিলবার্ট (Wally Gilbert) এবং পল বার্গের (Paul Berg) সাথে ১৯৮০ সালে রসায়নে নোবেল পুরষ্কার লাভ করেন। পরবর্তীতে ফ্রেডরিক স্যাঙ্গার ১৯৯৩ সালে কেমব্রিজের কাছে স্যাঞ্জার সেন্টার চালু করেন।
১৯৮৩ সালে জেমস গুসেলা (James Gusella) এবং তার দল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস জেনারেল হাসপাতালে সর্ব প্রথম হান্টিংটন রোগের (Huntington’s disease) জন্য দায়ী জিনের অবস্থানটি সনাক্ত করে।
১৯৮৩ সালে ড. ক্যারি মুলিস (Dr. Kary Mullis) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় সিটাস কর্পোরেশনে মানব ইতিহাসের অন্যতম যুগান্তকারী আবিষ্কার পলিমারেজ চেইন রিঅ্যাকশন (PCR) পদ্ধতি তৈরি করেন।
অ্যালেক জেফরিজ (Alec Jeffreys) ১৯৮৫ সালে ডিএনএ প্রোফাইলিংয়ের জন্য একটি পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন। যা দিয়ে জিনোমের দশটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে পাওয়া ডিএনএ ক্রমের সংক্ষিপ্ত পুনরাবৃত্তিক্রমের সংখ্যা গণনা করে একটি ডিএনএ প্রোফাইল তৈরি করা যায়।
১৯৯০ সালে হিউম্যান জিনোম প্রকল্প চালু করা হয়। এই প্রকল্পটির মূল লক্ষ্য ছিল ১৫ বছরের মধ্যে একটি মানব জিনোমের সমস্ত (৩ বিলিয়ন) অক্ষরকে সিক্যুয়েন্স করা। হিউম্যান জিনোম প্রকল্পের অংশ হিসাবে ১৯৯৯ সালে মানব দেহের ২২ নম্বর ক্রোমোসোমের সিকোয়েন্স সম্পন্ন করা হয়। অবশেষে ২০০১ সালে বহুল কাঙ্ক্ষিত মানব জিনোম সিকোয়েন্সের প্রথম খসড়া প্রকাশিত হয়। ২০০৩ সালে হিউম্যান জিনোম প্রকল্পটি সম্পন্ন হয় এবং দেখা যায় যে মানবদেহে প্রায় ২০,০০০ থেকে ২৫,০০০ জিন রয়েছে। কাঙ্ক্ষিত সময়সূচীর 2 বছর আগেই বিজ্ঞানীরা মানব জিনোম সিকোয়েন্সের ৯৯.৯৯ শতাংশ যথার্থতার সাথে সিকোয়েন্সড করতে সক্ষম হন।
১৯৯৫ সালে প্রথম ব্যাকটিরিয়ামের (Haemophilus influenza) এবং ১৯৯৬ সালে ইস্ট এর (Saccharomyces cerevisiae) জিনোম সিকোয়েন্স করা হয়।
১৯৯৬ সালে প্রথম ক্লোন করা প্রাণী (ভেড়া), ডলি্র জন্ম হয় রোজলিন ইনস্টিটিউটে।
জন সুলস্টন (ওয়েলকাম ট্রাস্ট স্যাঞ্জার ইনস্টিটিউট, কেমব্রিজ) এবং বব ওয়াটারস্টন (ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়, সেন্ট লুইস) ১৯৯৮ সালে নেমাটোড কৃমির জিনোম (C. elegans) প্রকাশ করেন।
২০০০ সালে মডেল জীব Drosophila melanogaster (ফলের ফ্লাই) এর সম্পূর্ণ জিনোম সিকোয়েন্স সম্পন্ন করা হয়।
ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, সান্তা ক্রুজ (UCSC) ২০০০ সালে UCSC জিনোম ব্রাউজার চালু করে।
মাউস প্রথম স্তন্যপায়ী যার সম্পূর্ণ জিনোম সিকোয়েন্সটি ২০০২ সালে সম্পন্ন করা হয়। এই প্রকল্পটি আন্তর্জাতিক মাউস জিনোম সিকোয়েন্সিং কনসোর্টিয়াম পরিচালনা করে। মাউস জিনোম মানব জিনোমের চেয়ে ১৪ শতাংশ ছোট তবে মাউসের জিনোমের ৯৫ শতাংশেরও বেশি মিল মানব জিনোমের।
২০০২ সালে আন্তর্জাতিক হ্যাপম্যাপ প্রকল্পটি (International HapMap Project) চালু করা হয়, যার মূল লক্ষ্য মানুষের জিনগত বৈচিত্রের একটি ‘ক্যাটালগ’ তৈরি করা। হ্যাপম্যাপ (মানব জিনগত পরিবর্তনের মানচিত্র) প্রকল্প নিয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন ২০০৫ সালে নেচার পাবলিকেশন্সে প্রকাশিত হয়।
ম্যালেরিয়া রোগ সৃষ্টিকারী Plasmodium falciparum পরজীবীর জিনোম সিকোয়েন্স করা হয় ২০০২ সালে।
জাতীয় মানব জিনোম গবেষণা ইনস্টিটিউট (National Human Genome Research Institute) ২০০৩ সালে মানব জিনোমের সমস্ত জিনকে চিহ্নিত করার লক্ষ্যে এনকোড প্রকল্পটি (ENCODE Project) চালু করে।
২০০৪ সালে ইঁদুরের জিনোমের High-quality খসড়া প্রকাশিত হয় যেখানে দেখা যায় যে এটি মানব জিনোমের চেয়ে ছোট তবে মাউসের জিনোমের চেয়ে বড়।
২০০৪ সালে Chicken জিনোম সিকোয়েন্স সম্পন্ন হয় এবং দেখা যায় যে প্রায় ২০,০০০ থেকে ২৩,০০০ জিন রয়েছে।
২০০৫ সালে শিম্পাঞ্জির জিনোম সিকোয়েন্স করা হয়।
২০০৮ সালে ১,০০০ জিনোমস প্রকল্পটি (1,000 Genomes Project) চালু করা হয় যার মূল লক্ষ্য হল বিপুল সংখ্যক লোকের পুরো জিনোম সিকোয়েন্স করা।
২০০৯ সালে ফুসফুসের ক্যান্সার এবং ম্যালিগন্যান্ট মেলানোমা সহ ক্যান্সারের জিনোমের প্রথম বিস্তারিত বিশ্লেষণ প্রকাশিত হয়।
২০০৯ সালে হেরফোর্ড (Hereford cow) গরুর জিনোম সিকোয়েন্স করা হয় এবং দেখা যায় যে প্রায় ২২,০০০ জিন রয়েছে যার মধ্যে প্রায় ১৪,০০০ জিনের মিল রয়েছে স্তন্যপায়ী প্রাণীর সাথে। গরুর জিনোমের ৮০ শতাংশেরও বেশি মিল মানব জিনোমের সাথে।
২০১০ সালে ওয়েলকাম ট্রাস্ট (Wellcome Trust) UK10K চালু করে যার লক্ষ্য ৪,০০০ স্বাস্থ্যকর মানুষের জিনোমের সাথে ৬,০০০ জিনগত কারণে রোগে বেঁচে থাকা মানুষের সাথে তুলনা করা।
২০১৩ সালে মার্কিন সুপ্রিম কোর্ট নিয়ম করে যে প্রাকৃতিকভাবে ঘটে যাওয়া ডিএনএ-কে পেটেন্ট দেওয়া যাবে না।
ডিএনএ (DNA) এর পূর্ণ রূপ হল ডিঅক্সি রাইবোনিউক্লিক এসিড (Deoxyribonucleic acid)। এই ডিএনএ কে বলা হয় জীবজগতের বংশগতির ধারক ও বাহক। জীবজগতের বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পায় এই ডিএনএ এর মাধ্যমেই। চারটি নাইট্রোজেন ঘটিত ক্ষারের যেকোনো একটি, একটি ফসফেট গ্রুপ এবং পাঁচ কার্বন বিশিষ্ট রাইবোজ সুগার নিয়ে গঠিত হয় ডিএনএ। এই চারটি ক্ষারের মাঝে আবার দুইটি ধরণ থাকে। একটি পিউরিন (অ্যাডেনিন ও গুয়ানিন) এবং অপরটি পাইরিমিডিন (সাইটোসিন ও থাইমিন)।
ডিএনএ অণুগুলো দুটো লম্বা সুতোর মতো একে অপরকে জড়িয়ে থাকে। এই সুতোর মতো কুণ্ডলিত ডিএনএ যখন হিস্টোন নামক প্রোটিন দিয়ে মোড়ানো থাকে তখন তাকে বলা হয় ক্রোমোজোম। জীবকোষের নিউক্লিয়াসের ভেতরের এই ক্রোমোজোমের মধ্যেই ডিএনএ এর অবস্থান। আর জিন হচ্ছে এই ডিএনএ এর একটি সুনির্দিষ্ট অংশ যেটি একটি নির্দিষ্ট প্রোটিনকে কোড করতে পারে। অর্থাৎ প্রোটিন সংশ্লেষণের জন্য প্রয়োজনীয় সব তথ্য জিনে অন্তর্নিহিত থাকে।
জীবজগতের কোন বৈশিষ্ট্য প্রকাশিত হওয়া বা না হওয়া সংশ্লিষ্ট জিনের এক্সপ্রেশনের উপর নির্ভর করে। অনেক সময় পরিবেশর উপর নির্ভর করে জিনের এক্সপ্রেশন পরিবর্তিত হয়। আবার সময়ের সাথে সাথে ও জিনে পরিবর্তন হয়। তারপরও সদৃশ প্রজাতিগুলোর মাঝে একটি নির্দিষ্ট জিনের কাছাকাছি অনুরূপ পাওয়া যায় এবং প্রজাতিগত দূরত্ব বাড়ার সাথে সাথে জিনগত পার্থক্যও বাড়ে। একটি নির্দিষ্ট প্রজাতির সকল জিনের সমষ্টিকে একসাথে জিনোম বলা হয়। যেকোনো জীবের বৈশিষ্ট্য প্রকাশের নিয়ন্ত্রক ও এই জিনোম। আসলে জিনোমের খুব সামান্য অংশই জিন। জিনোমের বেশির ভাগ অংশই হলো কোডবিহীন ডিএনএ। তাই কোন নির্দিষ্ট জীবের জিনকে শনাক্ত করতে হলে প্রথমে তার পুরো জিনোমকে সিকোয়েন্স করা প্রয়োজন। জিনোম সিকোয়েন্স মানে হলো শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ডিএনএ অণুর ভেতর চারটি নাইট্রোজেন (ATGC) ঘটিত ক্ষারের বেইস গুলো কিভাবে সাজানো আছে সেটা খুঁজে বের করা।
গবাদিপশু বা গরু আমাদের বহুল পরিচিত একটি প্রাণী। প্রাণিজগতের মধ্যে গরুই প্রথম স্তন্যপায়ী প্রাণী যার জিনোম সিকোয়েন্স করা হয়েছে। আনুমানিক ১০,০০০ বছর ধরে এই গবাদিপশু তাদের চামড়া, মাংস, দুধ এবং শক্তি দিয়ে মানব সভ্যতার অভাবনীয় উপকার করে আসছে। সর্বপ্রথম ২০০৩ সালে মানবদেহের পূর্ণাঙ্গ জিনোম সিকোয়েন্স প্রকাশিত হবার পর থেকেই গবেষকরা গরুর জিনোম সিকোয়েন্স করার চেষ্টা শুরু করেন। এই জন্য বেছে নেয়া হয় হেরিফোর্ড জাতের (Hereford cow - known as L1 Dominette 01449) গরু।
প্রাথমিকভাবে এই গবেষণা প্রকল্পে অর্থায়ন করে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ হেলথ এর ন্যাশনাল হিউম্যান জিনোম রিসার্চ ইনস্টিটিউট (NHGRI) এবং মার্কিন কৃষি বিভাগ (USDA)। পঁচিশটি (২৫) দেশের তিনশত (৩০০) বিজ্ঞানীর অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে দীর্ঘ ছয় বছর গবেষণার পর গরুর পূর্ণাঙ্গ জিনোম সিকোয়েন্স উন্মোচন করা হয়। এ গবেষণা দলের নেতৃত্বে ছিলেন অধ্যাপক ড. রিচার্ড এ গিবস (Richard A. Gibbs)। গবেষণালব্ধ প্রাথমিক ফলাফল দুই ভাগে সর্বপ্রথম ২০০৯ সালের ২৪ শে এপ্রিল বিশ্ববিখ্যাত সায়েন্স (Science) জার্নালে প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে এই গবেষণার বিশদ বিশ্লেষণ সহ আরো ২০ টিরও বেশি গবেষণাপত্র বায়োমেড সেন্ট্রাল (BioMed Central) ওপেন অ্যাক্সেস জার্নালে প্রকাশিত হয়।
প্রথম Science গবেষণাপত্রে দেখা যায় যে গরুর জিনোম ৩০ জোড়া ক্রোমোজোম নিয়ে গঠিত এবং জিনোমের আকার প্রায় ৩ জিবি (3 billion base pairs)। এতে প্রায় ২২,০০০ জিন রয়েছে যার মধ্যে ১৪,০০০ জিন সমস্ত স্তন্যপায়ী প্রজাতির জন্য সাধারণ। গবাদি পশু তাদের জিনের ৮০ শতাংশ মানুষের সাথে ভাগ করে। এই গবেষক দলের নেতৃত্বে ছিলেন আমেরিকার বেইলার কলেজ অফ মেডিসিনের জিনোম সিকোয়েন্সিং সেন্টার, মার্কিন কৃষি বিভাগ USDA এর কৃষি গবেষণা পরিষেবা (ARS), জর্জটাউন ইউনিভার্সিটি এবং CSIRO (The Commonwealth Scientific and Industrial Research Organisation) গবেষকগণ।
দ্বিতীয় Science গবেষণাপত্রে গবেষকগণ হেরিফোর্ড জাতের গরুর জিনোমকে রেফারেন্স জিনোম ধরে আরো ছয় (৬) জাতের গরুর (Holstein, Angus, Jersey, Limousin, Norwegian Red and Brahman) জিনোমের সাথে তুলনা করেন। এই গবেষক দলের নেতৃত্বে ছিলেন আমেরিকার বেইলার কলেজ অফ মেডিসিনের জিনোম সিকোয়েন্সিং সেন্টার, ARS এবং মিসৌরি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকগণ। এরপর ১৯ টি ভৌগলিক এবং জৈবিকভাবে স্বতন্ত্র জাতের ৪৯৭ টি গবাদি পশুর উপর ফলো-আপ স্টাডি করেন।
বর্তমান সময়ে গরুর মাংস এবং দুগ্ধ শিল্পের অভাবনীয় উন্নতির পেছনে রয়েছে জিনোম সিকোয়েন্সের সাথে সংশ্লিষ্ট সকল বিজ্ঞানিদের অসামান্য অবদান।